উন্নয়ন ও বর্তমান বাংলাদেশ (পার্ট ১)ঃ উন্নয়ন কাকে বলে, উন্নয়নের ধরণ ও উন্নয়ন মতবাদ ।
- এন জে শাওন
বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা, টকশো, খবর, এবং বিশেষ করে রাজনৈতিক বক্তব্যগুলো শুনলে নেগেটিভ শব্দগুলো বাদে যে পজিটিভ শব্দ গুলো শোনা হয়, পড়া হয়, বলা হয় সেগুলো হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ ও উন্নয়ন।
ডিজিটাল বাংলাদেশ শব্দটি মোটামুটি খেই হারিয়ে ফেলেছে, পুরোনো হয়ে গেছে কিন্তু তরতাজা আছে উন্নয়ন শব্দটি।
শিল্প উন্নয়ন, জিডিপি উন্নয়ন, রাস্তঘাট উন্নয়ন, রেলপথ উন্নয়ন, কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়ন, রিজার্ভ টাকা রাখায় উন্নয়ন, রেমিট্যান্স উন্নয়ন, তথ্য প্রযুক্তিতে উন্নয়ন ইত্যাদির সাথে উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ এই শব্দগুলোই বারবার চখের সামনে আসে। উন্নয়নের মহাসড়ক শব্দটি এত বহুল চর্চা হচ্ছে যে, শব্দগুলো যুগলবন্দী হয়ে অভিধানে স্থান নেওয়ার দাবিদার।
যাই হোক, এই উন্নয়নটা আসলে
কি , বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে উন্নয়নের কয়টি শর্ত পালন করছে বা যেসবকে উন্নয়ন বলছে সেসব আদৌ উন্নয়ন কি না, কিংবা বহির্বিশ্বে এবং আমাদের দেশের যে পরিসংখ্যাংনগুলো পড়ি সেগুলো আসলে কতটা উন্নয়নের সাথে সংযুক্ত তা জানার জন্য শুরু করলাম নিজেই গুগল সার্চ, পেপার কাটিং ও রিসার্চ পেপার পড়া। তার নিমিত্তেই এই নিবন্ধ।
প্রথমে জানতে হবে উন্নয়ন কি? উন্নয়ন সম্পর্কে কে কি বলেছে, কখন কেমন ধারণা বা মতবাদ প্রচলিত ছিল ইত্যাদি। আমি এই পোস্টে মতবাদ না কপচিয়ে সহজ ভাষায় উন্নয়ন সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো। এবং পরবর্তী নিবন্ধতে তাকে বাংলাদেশের সাথে তুলনা করবো, পরখ করবো।
উন্নয়ন কাকে বলে বা উন্নয়নের সংজ্ঞা কি?
উন্নয়নের গ্রহণীয় আদর্শ কোন সংজ্ঞা নেই। এক দলের কাছে , এক পেশার কাছে উন্নয়ন একেকরকম ।
প্রযুক্তিবিদদের মতে ,প্রযুক্তি এগিয়ে যাওয়া। অর্থনীতিবিদদের মতে অর্থনীতিতির সুষম বন্টন। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, সমাজ ও সংস্কারের পজিটিব পরিবর্তন, মানবাধিকার কর্মীদের মতে সমাজের সবার ন্যায্য অধিকার, স্বাধীনতা ইত্যাদি।
এবং একটা দেশে উন্নয়ন বলতে এই সামগ্রিক উন্নয়নকেই বুঝায়। তাও একপক্ষের কাছে এক রকমতো আরেক পক্ষের কাছে আরেক রকম । এই সময় এক রকমতো অন্য সময়ে আরেকরকম।
মার্ক্সবাদীদের মতে, সহজ কথায় উপনিবেশ দূর করাটাই উন্নয়ন এবং পুঁজিবাদীদের মতে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মান বৃদ্ধি পাওয়াই উন্নয়ন।
এবার আসি উন্নয়নের শুরু কখন থেকে?
স্বাভাবিক ভাবে মানুষের পৃথিবীতে পা পরার থেকেই উন্নয়ন শুরু। কিন্তু রাষ্ট্রভেদে উন্নয়নের ধারণা জনপ্রিয় হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর।
এই সময়ই উন্নয়নের মতবাদ বা থিওরী এবং উন্নয়নের সংজ্ঞা নির্ণয় করা হতে থাকে।
১৯৫০-১৯৬০ঃ (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি)
এই সময়ে উন্নয়নের থিওরীর যাত্রা শুরু। সহজভাবে বলতে গেলে এই সময় উন্নয়ন বলতে মনে করতে হতো অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই। আর্থিকভাবে কোন দেশ উপরে উঠতে পারাই মানে ঐ দেশের উন্নয়ন বুঝানো হত। এর নাম ছিল ট্রিকল ডাউন থিওরি। তবে এই সময়ে আরো কিছু মতবাদ সৃষ্টি হয় যেমন নির্ভরশীলতা তত্ত্ব, কাঠামোবাদ ইত্যাদি। কাঠামোবাদ বলতে বুঝানো হয় দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
১৯৭০ঃ (আবশ্যকীয় চাহিদার উন্নয়ন)
১৯৭০ এ এসে উন্নয়ন মানুষের আবশ্যকীয় চাহিদার উপর গুরুত্ব করেছেন। মৌলিক চাহিদা বলতে নির্ধারণ করা হয়েছিল খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ও বেকারত্ব (Harris, 2000; Seers, 1969).
এই সময়ে অর্থের সংখ্যার চেয়ে মানুষের মানকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়েছে। সাথে অর্থের সুষম বন্টনের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
এই সময়তেই মানব উন্নয়ন সূচকে জিডিপির পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য যোগ করা হয়েছে।
১৯৮০ঃ(বাণিজ্যের স্বাধীনতা)
এই দশকে এসে উন্নয়নে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সাধারণ মানুষও উন্নয়নেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনার সুযোগ হয়েছে। বেসরকারি শিল্প কারখানা তৈরী, ব্যবসা বাণিজ্যে সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ কমানো ইত্যাদি মানে উন্নয়ন বলা হতো।
১৯৯০ঃ (মানবকেন্দ্রিক উন্নয়ন)
এই দশকে এসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারণা খুবই সংকীর্ণ হয়ে গেছে। মানুষের ব্যাক্তিগত উন্নয়ন অর্থাৎ মানুষের ইচ্ছেমত বেঁচে থাকার স্বাধীনতা, জ্ঞান আহরণের সুযোগ, একতা স্বাভাবিক জীবন ধারণের ক্ষমতা ইত্যাদি উন্নয়নের নির্দেশক হিসেবে কাজ করতো। এ সময়ের মূল ধারণা ছিল ‘ উন্নয়ন আয় ও অর্থের উপর নজর রাখলেও এর মেইন ফোকাসড হচ্ছে মানুষের উন্নতি ঘটানো’
২০০০ঃ
এই শতকে এসে উন্নয়ন শুধুমাত্র এক দুটি নির্দেশকের উপর পরে থাকেনি। বাস্তবতা ও থিওরী উভয় মিলে নির্ধারণ করা হয় উন্নয়নের সংজ্ঞা ও লক্ষ্য ২০০০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এমডিজির (মিলেনিয়াম ডেভেলমেন্ট গোলস) নির্ধারণ করা হয়। ২০১৫ এর পর আবার নতুন করে তৈরী করা হয় এসডিজি (সাস্টেনেইবল ডেভেলপমেন্ট গোল ) লক্ষ্য।
অমর্ত্য সেনের উন্নয়ন থিওরীঃ
ভারতের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার ‘ডেভেলপমেন্ট এজ ফ্রীডম’ বইটিতে উন্নয়নের নতুন ধারণা দিয়েছেন। এটি অন্যান্য ধারনা থেকে অনেকটাই আলাদা।
তার তত্ত্ব্ব নিয়ে তার বিশাল বইটি এখানে আলোচনা করা সম্ভব না বিধায় আমি সংক্ষেপে একটু ধারণা দিলাম।
তিনি জিডিপির পাশাপাশি স্বাধীনতা, পছন্দ (চয়েস), ও সক্ষমতার ভিত্তিতে উন্নয়নকে দেখতে বলেছেন।
তার কাছে উন্নয়ন বলতে মানুষের স্বাধীনতার সম্প্রসারণ ঘটানো, মানুষ তার নিজের জীবন ধরণের পদ্ধতি নিজে বাছাই করার সুযোগ এবং তার ইচ্ছে পূরণ করার সক্ষমতাকে বুঝিয়েছেন। এখানে সক্ষমতা শব্দটি সাধারণ সক্ষমতা শব্দ থেকে ভিন্ন।
এখানে সক্ষমতা বলতে মানুষের কি আছে তা না, মানুষ যা হতে চায় তার সুযোগ আছে কি না তা বুঝানো হয়েছে। যেমনঃ একটা ছেলে হকি খেলোয়াড় হতে চায়। সমাজ ও রাষ্ট্র তাঁকে সে সুযোগ করে দিতে পারছে কি না তাই ওই রাষ্ট্রের উন্নয়ন। একটা ছেলে গবেষক হতে চায়। রাষ্ট্র তারে এই ব্যাপারে কতুটুকু সুযোগ সহজলভ্য করেছে তা উন্নয়নের নির্ধারক।
সহজ কথায় তার মতে মানুষ স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছেমত জীবন ধারনের ক্ষমতা এবং তাতে রাষ্ট্রের ভূমিকা হচ্ছে উন্নয়ন।
ভাবছিলাম এই পোস্টেই বাংলাদেশের উন্নয়ন পর্যালোচনা করবো কিন্তু তা সম্ভব হয়নি অনেক বর হয়ে গেল বিধায়।
এতক্ষনে আপনার অবশ্যই উন্নয়ন সম্পর্কে একতা ধারণা প্যেছেন এবং বাংলাদেশের সাথে মিলিয়ে ফেলেছেন তবুও আগামী পর্বে বাংলাদেশের বর্তমান ( শুধু এখনকারটাইয়া লিখবো , পূর্বেরগুলো সহ লিখলে অনেক সময় লাগবে এবং তা বিশাল হয়ে যাবে।)
No comments:
Post a Comment